যে হেতু
সমাজের বিভিন্ন স্তরে স্পর্শ করে এমন তুকারামের কাব্য বাস্তবিক কালোতীর্ণ | ভাষা,
কাল, প্রান্ত এ সব বন্ধন পার করে এই কাব্য পাঠকদের নিজের মনে হয় |স্বতন্ত্রতাপূর্বকালীন,
মারাঠী ভাষাতে লেখা এই সঙ্গতিপন্ন সাহিত্য বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বঙ্গের বিপ্লবী,
চিত্রনাট্যশিল্পী ও লেখকদের মধ্যে লোকপ্রিয় ছিল | পূর্ব বঙ্গ মানে এখনকার
বাঙ্গলাদেশের বরিশাল জেলার বিপ্লবী - অশ্বিনীকুমার দত্ত ( ১৮৫৬ - ১৯২৮) তুকারাম গাথা
নিযমিতরূপে পড়তেন | তিনি বহুভাষাজ্ঞানী ছিলেন | মারাঠী, হিন্দী , উর্দূ, ইংগ্রজী ও
পাঞ্জাবী জানতেন | ১৯১০ সালে কলিকাতায় শিবাজী উত্সব সমিতীর তিনি অধ্যক্ষ ছিলেন |
তুকারামের একখানা জীবনী বাংলায লেখা হয়েছে | তুকারাম জীবনীরচনকার লেখক যোগেন্দ্রনাথ
বসূ একজন উচ্চ মানের কবি, সাহিত্যকার এবং প্রবন্ধলেখক ছিলেন | সত্যেন্দ্রনাথ
ঠাকুরের "ভারতী" নামে বাংলা মাসিক পত্রিকায় প্রসিদ্ধ হওয়া জীবনচরিতরূপ প্রবন্ধের
মাধ্যমে তুকারামের সাথে যোগেন্দ্রনাথের প্রথম পরিচয় | এই প্রবন্ধ পড়ে তুকারামের
পারমার্থিক জীবন এবং ওনার কবিতার, কাব্যের প্রতি যোগেন্দ্রবাবুর মনে বিলক্ষণ কুতূহল
জন্মাল | তুকারামের মারাঠী ভাষা শেখা ও ওনাকে পরিপাটিরূপে জেনে নেবার জন্য তাঁর মন
ব্যাকুল হয়ে ছিল | সৌভাগ্যবশত: বিখ্যাত মারাঠী লেখক - "সখারাম গণেশ দেউসকর " জিনি
বাংলাতে ও লিখতেন এবং যোগেন্দ্রনাথের ছাত্র ছিলেন |
নিজের লেখনীর বলে বাঙ্গলায
শিবাজীমহারাজার সুপরিচয় বঙ্গসমাজে তিনিই প্রথমবার করিয়েছিলেন | ১৯০৪ সালে দেউসকর
মহাশয়ের নেতৃত্বে বঙ্গদেশে শিবাজী উত্সব আরম্ভ হোয়েছিল | বাঙ্গলা লেখকদের মধ্যে এই
মরাঠী লেখকের স্থান অনেক উচ্চ | যোগেন্দ্রনাথবাবু এই ছাত্রের কাছে মারাঠী ভাষা
শিখেছিলেন | তার সাহায্যে তুকারামের অভঙ্গ এবং উনারসম্বন্ধে মারাঠিতে পাওয়া গেছে
এমন সব সাহিত্য ও তিনি যত্ন করে পড়েছিলেন | এই পড়াশুনার ফলে "দাসী " নামে একটি
মাসিক পত্রিকায় - " যেটা এখন নামশেষ " তাতে ক্রমশ: প্রসিদ্ধ হওয়া এবং পরে বইরূপে
মুদ্রিত হওয়া "তুকারাম জীবন চরিত " বইটার দ্বিতীয় সংস্করণ ১৯১৭ সালে প্রকাশিত হয়েছে
| ( ক্রাঊন ষোলো পৃষ্ঠা হিসাবে ১২৬ পৃষ্ঠার বই )
তুকরাম জীবন চরিত থেকে কয়েকটা
অনুবাদিত অভঙ্গ
চাহিনা না যে সব নাথ , কেনো গো
দিতেছো মোরে নিরন্তর কেন হেন ফেলিছো সঙ্কটে ঘোরে
?
সংসার হইতে সদা দূরে রহিবা রে চাই
|
মানবের সাথ আর করিতে বাসনা নাই ||
বিজন বিপিনমাঝে সতত হরষে রবো |
জগতের কারও সনে কখন ও না কথা কবো |
এইমাত্র চাই প্রভো, যেন দেহ, ধন ,
জন |
বমনসদৃশ পারি করিবারে দরশন |
তুকা বোলে , পদে তব এই নিবেদন করি |
সকল ই, তোমার ই ইচ্ছা হে পণ্ঢরীপতি হরি ||
প্রচণ্ড় অনলে দেহ করছে দহন |
এ সময়
কোথা হরি ! কর গো রক্ষণ |
জনক জননী প্রভু তুমি ই আমার |
এসো
তবে কৃপা করো এসো একবার |
আপাদমস্তক হেরো দহিছে অনলে |
নাহি
পারি ভাসি আঁখি জলে |
ভরে বুঝি গেল বুক সহেনা যে আর |
দাংডাইযা কি দেখিছো ও হে কৃপাধার |
শান্তির সলিল লয়ে , এসো ত্বরা করো |
তোমা বিনা কেবা মোরে উদ্ধরিবে হরি |
তুকা বোলে তুমি তো গো জননী আমার |
ক্ষমা দিনা কেবা মোরে করিয়ে নিস্তার ||
জীবন চরিতের শেষে
যোগেন্দ্রনাথ লিখেছেন - "বৈরাগ্য, বিনয় ও ভগবত্প্রেম এই ত্রিগুণ ই তুকারাম জীবন
চরিতের সারকথা | কেবল শুধু ভক্তির বলে তুকারাম লোকহৃদয় জয় করেছিলেন|
সত্যেন্দ্রনাথ
ঠাকূর (১৮৪২-১৯২৩) অবধি ICS
ইংডিযন সিভিল সার্ভিসে ছিলেন | চাকরীজন্য অনেক সময় তিনি অহমদাবাদ, মুম্বঈ, কারওয়ার,
পুণে এইসব জায়গায় থাকতেন ; সেই সময় প্রার্থনা সমাজের লোকদের সাথে দেখাশুনা হওয়ার
জন্য তুকারামের দিকে উনার মন আকর্ষিত হয়ে ছিলো | ১৮৭১ সালে পুণেতে তিনি বিচারপতি (জজ)
ছিলেন | সেইসময় ওখানকার প্রার্থনাসমাজে তিনি মারাঠিতে বক্ত্তৃতা দিতেন |
বোম্বাই প্রদেশে
পূনা নগের একটি প্রার্থনাসমাজ স্থাপিত হোইয়াছে | তাহার উপাসনাপ্রণালি অনেক পরিমাণে
আদিব্রাহ্মসমাজের ন্যায | তাহাতে শ্রীযুক্ত বাবু সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকূর মহাশয়
মহারাষ্ট্রীয় ভাষায় বক্তৃতা করিযা থাকেন " এরকম উল্লেখ "তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় "
আষাঢ ১৮৭২ সালে পাওয়া যায় |
মারাঠি ভাষা অতি
সূক্ষ্মভাবে পড়ে তিনি তুকারাম জীবন চরিতের উপর প্রবন্ধ তো লিখেলেন ই , তা ছাড়া
কযেকটি অভঙ্গের বাংলায় অনুবাদ করলেন | তা থেকে প্রেরণা নিয়ে উনার ছোট ভাই
রবীন্দ্রনাথ ঠাকূর তুকারামের কয়েকটি নির্বাচিত অভঙ্গ বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন |
একজন বিদ্বান ’জন বিম্স’ , নিজের লেখা বই " দি প্রোজেক্ট গটেনবর্গ ~ওফ চৈতন্য ~অন্ড
দি বৈষ্ণব পোএটস ~ওফ বঙ্গাল তে লিখেছেন যে -
বাঙ্গলা পদকল্পতরু ও তুকারামের অভঙ্গ দুইটার বিবিধ প্রসঙ্গে অনেকটা সাম্য, মিল দেখা
যায় | এবং লোকের সামনে উপস্থাপিত করার দুটোর যে ভড্গী তাতে ও প্রচণ্ড মিল |
মহারাষ্ট্রের
এমন একজন শ্রেষ্ঠ, বহুজনপ্রিয় সন্তের সুযোগ্য পরিচয় সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকূর ও
যোগেন্দ্রনাথ বসু করে দিয়েছিলেন এবং সেটাকে দৃঢতর করে দিলেন বসু ও চট্টোপাধ্যায় |
১৯৪৫ সালে শান্তিনিকেতনের চিত্রশিল্পি নন্দলাল বসু "গাথা"রজন্য তুকারামের ছয়টি ছবি
এঁকেছিলেন | ১৯২৯ সালে হরিন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ইংগ্রজীতে তুকারাম কে নিয়ে নাটক
লিখেছিলেন | ভারতীয় ভাষাদের মধ্যে তুকারামের পরিচয় করে দেআনোরজন্য ভালচংদ্র নেমাডের
যে বই সাহিত্য অকাদমী 1975
তে প্রসিধ্দ করে ছে | তার উপরের তুকারামের ছবিটা সত্যজিত রায এঁকেছেন.অশ্বিনীকুমার
দত্তর প্রপৌত্রী গাযত্রী চাটর্জী সম্প্রতি " সন্ত তুকারাম " বই লিখছেন | এ বঈটা "সন্ত
তুকরাম" সিনেমার সম্বন্ধে লেখা | |